দেশ থেকে দেশে তাঞ্জানিয়া, বিচিত্র দেশে বিচিত্র অভিজ্ঞতা || মনিরুল ইসলাম

(গত সপ্তাহের পর)
২১/০১ জাঞ্জিবার স্টোন টাউন ঘুরে দেখলাম। পুরো শহর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। দরজা—জানালা—বারান্দা নকশা করে গঠিত পুরনো বিল্ডিং। চোখে পড়ে আরব, আফ্রিকা, ইউরোপ ও পার্সিয়ান সংস্কৃতির মিশ্রণ। সোয়াহিলি জাতির জাদুঘর আছে কয়েকটি। গাঢ় নীল—বেগুনী রঙের বিখ্যাত তাঞ্জানাইট স্টোন দেখলাম অনেক দোকানে, সত্যি দৃষ্টিনন্দন মনোহরÑকিনব কিনা বুঝতে পারছি না। সরু গলিপথ ঘুরে ঘুরে কাঁচাবাজারে গিয়ে পৌঁছলাম। মাছ ও মসলার আধিক্য। সেই দাস ব্যবসায়ী টিপ্পু টিপ—এর বাড়িও আছে সংরক্ষিত। কিন্তু তিনি কি এখনো স্বর্গলোকে তার পাপার্জিত সম্পত্তি নিয়ে বিভোর? আহা, মানুষ কেন এত অন্যায় করে? বিখ্যাত ‘লোকমান’ রেস্টুরেন্ট দেখলাম, কী এমন ‘জাঞ্জিবার পোলাও’ যার জন্য মানুষ পাগল? খেয়ে দেখি আমার স্ত্রীর পোলাও এরচেয়ে অসংখ্যগুণ সুস্বাদু। এতটুকু শহরে খ্রিস্টানদের চার্চ ও হিন্দুদের মন্দির আছে সচল। ‘ভিক্টোরিয়া গার্ডেন্স’—এ দেখি মেয়েরা গ্রুপ গ্রুপ পড়াশুনা করছে শিক্ষকের কাছে। পার্কে এরা প্রেম করে না, ভালোবাসলে সরাসরি বাড়িতে একসাথে বসবাস করে। আমাদের মতো ন্যাকামি উন্মাদনা অভিমান অভিসার অশ্রম্নপাত করে না, আঠার মতো বেহায়া হয়ে লেগে থাকে না। সর্বনাশা সর্বগ্রাসী আবেগ থেকে আমাদের বাঙালিমন মুক্ত হতে পারে না।
ছোট লঞ্চে গেলাম প্রিজনার্স আইল্যান্ড। দাসদের বিক্রয় তথা রপ্তানিকেন্দ্র ছিল এটি। পশ্চিম আফ্রিকায় যেমন সেনেগালের গোরী আইল্যান্ড (আটলান্টিক), পূর্ব আফ্রিকায় তেমনি প্রিজনার্স আইল্যান্ডে (ভারত মহাসাগর) সেই মর্মান্তিক ইতিহাসের নিদর্শন দেখলাম। এখানে ছোটছোট গুদামঘরে ধরে আনা মানুষ রাখা হত, গরু মাছ কাঠ মসলার মতো ‘মানুষপণ্যে’র নিলাম ডাকা হত। মানুষের দেহগঠন, শক্তি ও বয়স বুঝে দামদর ঠিক হত। তারপর খুচরা বিক্রির জন্য শিকলবন্দি মানুষগুলিকে জাহাজে পাঠানো হত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
দ্বীপে বিশালাকার শতবষীর্ কচ্ছপ আছে অনেক। ঘাস—পাতা—সবজি—ফল খেয়ে বেঁচে থাকে এরা। কয়েকটা বিদেশি সাদা যুবতী দেখি শুধু ব্রা—নেংটি পরে দলের সাথে হাঁটছে। দেখে মনে হয় গরমের দিনে মেয়েরা নগ্ন থাকতেই পছন্দ করে। অগভীর পরিষ্কার স্বচ্ছ পানিতে লোকজন সার্ফিং, স্কিয়িং, স্কুভা—ডাইভিং, স্নোরকেলিং, ফিশিং করছে। ভূপৃষ্ঠের মানুষ সবই দেখতে চায়Ñমাটির উপরে, ভূতলে, আকাশে, মহাশূন্যে ও পাতালে। ইমরানের অভিজ্ঞতা শুনে মনে হল পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে তো দেখলাম অনেক কিছু, এবার সাগর তলদেশের সৌন্দর্য দেখা দরকার।
দারুস সালাম ফিরে সন্ধ্যায় আম ও কাজুবাদাম কিনলাম, তাঞ্জানাইট ও শুঁটকির সব দোকান বন্ধ। বাংলাদেশের স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতিনিধি ইনতেখাব আদনান শাকিব ডিনার খাওয়াল পশ ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁ এপিডর—এ। পাশের টেবিলে একটা কালোমেয়ে গ্লাসের পর গ্লাস রেডওয়াইন খাচ্ছে, হয়ত বয়ফ্রেন্ডকে চুটিয়ে। আমার রাগ লাগল দেখে, সেকেলে মানসিকতা গেল না আমার।
২২/০১ শেষদিন, শহর দেখলাম ঘুরে। এদেশেও ব্যবসা যথারীতি ভারতীয়দের দখলে, বংশ পরস্পরায়। সরকার দুনীর্তি বন্ধের আইন করে দুনীর্তি বাড়িয়েছে, বলে স্থানীয়রা। মধ্যরাতে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিল সাকিব এবং অলিউল্লাহ। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে কিন্তু ঘুমের সুযোগ নাই, সীটে বসে আমি ঘুমাতে পারি না।
পৃথিবীতে মানুষের জীবন সম্পর্কে জানাই এখন নেশা আমার। খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করায় তাঞ্জানিয়া সম্পর্কে দুই স্থানীয় গাড়িচালক ও বাংলাদেশীরা যেসব তথ্য দিলেন, তা চমকপ্রদ:
— খ্রিস্টান—মুসলমান আধাআধি। তবে ধর্ম নিয়ে এরা নিরপেক্ষ, ভারত উপমহাদেশের মতো গোঁড়া নয়। এক ধর্মের ছেলেমেয়ে অন্যধর্মে বিয়ে করে, সন্তান ইচ্ছামতো ধর্মাবলম্বন করে, চাইলে পরিবর্তনও করে।
— সুখ—শান্তি বজায় না থাকলে পার্টনার বাদ/বদলায়। বিয়ে—সংসারে আগ্রহ কম। বিয়ে করলেই সমস্যা, অনিশ্চয়তা, পুনর্বিবাহে বাধা। একের বউ/স্বামী অন্যে নিয়ে যায়! অল্প খরচে সহজে মানুষ ‘কিনে ফেলা’ যায়।
— মানুষের ওজন বুঝে কথা বলে, দরাদরি করতে দাম চায় বেশি।
— গায়ে পড়ে কাউকে খুশি করতে চায় না, তোষামোদি করে না।
— সময়জ্ঞান কম, প্রতিশ্রম্নতিকে শ্রদ্ধা করে না।
— বুদ্ধি আছে, খাটায় নাÑসব করে দায়সারা গোছের।
— নিজের সুখশান্তিই বড়কথা, অন্যের জন্য টেনশন বা পরশ্রীকাতরতা নেই কিছুতেই।
— আজ তো খেলাম, আগামীকালের জন্য ভাবনা—পরিকল্পনা কেন? অতীত তো নয়ই, গতকাল থেকেও শিক্ষা নেয় না।
— বড়লোক হওয়ার দুর্বাসনা নাই। জীবন, খাওয়া, পরা সবই সহজ সাধারণ স্বাভাবিক। উৎকট উদগ্রীব উচ্ছ্বাস কম।
— না খেয়েও রাগ নেই, না পেলেও দুঃখ পোষণ করে না।
— চুরি—বাটপারি—খেয়ানতিকে অন্যায় মনে করে না, বিশ^াস করার মতো লোক পাওয়া কঠিন।
— ডাকাতি করে না, তবে খুনি হতে আপত্তি নাই ‘মাসাই’দের।
— মেয়েরা প্রতিদিন পোশাক বদল করতে চায়।
— গাড়িচালক এর্নেস্ট লিক্সন লিভিং টুগেদার করে। তার এক বোন, মা অন্যশহরে, বাবা অকালমৃত।
— বিপদে পড়লে পরিবার—স্বজন থেকে সাপোর্ট সান্ত্বনা পায়। বিয়ে নয়, রক্ত—সম্পর্কটা বড়।
শুধু তাঞ্জানিয়া নয়, আফ্রিকার অনেক দেশ সম্পর্কেই এসব তথ্য অনেকাংশে সত্য ও প্রযোজ্য। ভাল—মন্দের বিচার আমার নয়, আমি তো বাইরের মানুষÑকীভাবে বুঝব এদের জীবনধারা।