অনিশ্চয়তাই এখন কেবল নিশ্চিত || আনিস আহমেদ
আমরা যেন বিশ্বব্যাপী এক অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করছি। এই যে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও গাজার মধ্যে শান্তি চু্ক্তি কার্যকর হলো, তাতে আশার আলো যেমন বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তেমনি রয়ে গেছে আশংকাও। এই যুদ্ধবিরতি কি টেকসই হবে? কারণ এখনও এ নিয়ে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ভাবে মতভেদ চলছে। কিন্তু সবচেয়ে নিশ্চিত অনিশ্চয়তা চলছে বাংলাদেশে। পরিহাসের ব্যাপার হচ্ছে যে বাংলাদেশে এখন ওটাই একমাত্র নিশ্চিত সত্য যে সবকিছুই অনিশ্চিত। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস, দেশে—বিদেশে সর্বত্রই জোর দিয়েই বলে চলেছেন যে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে, রোজার আগেই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেটাও নিশ্চিত ভাবেই অনিশ্চিত কারণ তার আগেই জুলাই সনদের বৈধতা প্রদানের দাবি তুলছে এনসিপি। জামায়াতে ইসলামি বলছে জুলাই সনদের ব্যাপারে নভেম্বরে বা ডিসেম্বরেই গণভোট অনুষ্ঠিত হোক। আবার কেউ কেউ বলছে যে এ নিয়ে সাধারণ নির্বাচনের দিনই গণভোট হোক। অতএব বোঝাই যাচ্ছে যে বাংলাদেশের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্বিধা—দ্বন্দ্ব এবং অনিশ্চয়তার কোন অবসানই ঘটছে না। ও দিকে আবার সশস্ত্র বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার বিচারের প্রশ্নে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার মতপার্থক্য ক্রমশই গভীর হচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। বিএনপি’র অন্যতম নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালো থাকা দরকার, নইলে তাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এনসিপি’র প্রধান নাহিদ ইসলাম, যিনি চব্বিশের আন্দোলনের মূল নেতা ছিলেন তিনি তো বলেই ফেললেন যে উপদেষ্টারা তার কথায়, ‘সেইফ এক্সিট’ খঁুজছেন। আবার অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তে নির্বাচনের জন্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথাও শোনা যাচ্ছে। তাই বলছিলাম এতগুলো অনিশ্চয়তাই এখন একমাত্র নিশ্চিত সংবাদ। সে জন্যই বড় মাপের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এখন হিমশিম খাচ্ছেন এটা বুঝতে যে অবশেষে বাংলাদেশে কি হতে যাচ্ছে। নাকি এই ধরনের টালমাটাল অবস্থার প্রেক্ষাপট কি ড. ইউনুসকে তার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য নতুন যৌক্তিকতা দেবে!
তবে এই রাজনৈতিক ডামাডোলের চাইতেও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে কি বাঙালি তার মুক্তিযুদ্ধোত্তর সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব হারাতে বসেছে? এই সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের জন্য বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করেছে দীর্ঘদিন। ভাষা আন্দোলনও ছিল, মূলত এই সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা সেই সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে ফিরিয়ে এনেছিলাম যেখানে বাঙালি হিসেবে আমাদের জাতিসত্ত্বার পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সেই সত্ত্বাকে বিলুপ্ত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে বার বার। তবে জুলাইয়ের আন্দোলনের পর যে কট্টরবাদী দলগুলো সাম্প্রতিক সময়ে প্রাধান্য পাচ্ছে তারা বাংলাদেশের মানুষকে তাদের নিজেদের বাঙালি সংস্কৃতি থেকে পরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এই সব দল বাহ্যত উদারতার কথা বলছে, এমনকি পূজা পার্বনেও তাদের সমর্থন দেয়ার কথা বলছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা বাংলাদেশের মানুষকে তাদের সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে।
সে রকমই এক ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ বকুলতলায়। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর ‘শরৎ উৎসব’ আয়োজনের অনুমতি বাতিল করে দেয়। প্রতিবছর সেখানে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় কিন্তু এ বছর ‘গোলযোগ’ এর আশঙ্কার কথা জানিয়ে বাতিল করে দেয়। এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে অনুষ্ঠান করা নিয়ে অনেকের কাছ থেকে আপত্তি এসেছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের নানা পক্ষ থেকেও আপত্তি থাকার কারণে অনুষ্ঠানটি এখানে করতে মানা করা হয়েছে।’ এই যে তিনি বললেন ‘শিক্ষার্থীদের নানা পক্ষ থেকে’ সেটি আমাদেরকে আমাদেরই ভবিষ্যত সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এই প্রজন্মের তরুণ শিক্ষার্থীদের যেখানে অনেক বেশি উদার হওয়ার কথা সেখানে শিক্ষার্থীদের এই মনোভাব আমাদের অবশ্যই ভাবিয়ে তোলে। এই শিক্ষার্থী কারা? তারা কি ইসলামি ছাত্র শিবিরের সদস্য যারা তাদের অভিভাবক দল জামায়াতে ইসলামির আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে? তারা সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নগুলির নির্বাচনে জয়লাভ করে, সেই পাকিস্তান আমলের ধারণাকে সম্ভবত বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে জয়লাভ করার অধিকার নিশ্চয়ই যে কোনো দলের রয়েছে। কিন্তু তাদের নির্বাচনের ম্যানিফেস্টোতে অবশ্যই এ রকম কথা থাকার প্রয়োজন ছিল যে তারা বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিপরীতে কোনো ধরনের অবস্থান নিতে পারবে না। ম্যানিফেস্টোতে কেবল নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য এই শর্তগুলো আবশ্যিক করার। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমানে যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন, তাদের বেশির ভাগই এই কট্টরবাদী ঘরানার লোক। সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানো কি আদৌ সম্ভব? তাই বিগত ১৯ বছর ধরে চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় যে শরৎ উৎসব হয়ে আসছিল তা যে কতিপয় শিক্ষার্থীর আপত্তির কারণে হতে পারেনি তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ এখন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
সুতরাং অনিশ্চয়তা এখন কেবল রাজনীতির অঙ্গনে নয়, এই অনিশ্চয়তা রয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও। সে জন্যই রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রকৃত পক্ষে কি হতে যাচ্ছে সেটা যেমন আমরা বুঝতে পারি না, তেমনি বুঝতে পারিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতই বা কি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এক বিরাট রকমের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। যেটা নিশ্চিত সেটা হলো এই সামগ্রিক অনিশ্চয়তা।